ESSAY by INDRANI BHATTACHARYA PAL

ভারতীয় দর্শনে আত্মা: একটি আধুনিক অন্বেষণ
ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য পাল

'ও দিকে অসীম যিনি তিনি স্বয়ং করেছেন সাধনা, মানুষের সীমানায়, তাকেই বলে আমি।' - এই আমি  বা আত্মার গহন গভীর রহস্য রাখবি যত সহজে উদগত করেছেন, তা কিন্তু  অনির্বাণ  আলোকপ্রাপ্ত মহাঋষিদের কাছে এত সহজে উপলব্ধ হয় না।  ভারতীয়  দর্শনের প্রতি ছত্রেএই "আমি"কে পেতে চাওয়ার  উপায় অন্বেষণ এর চালচিত্র ধরা পড়ে। অতি নাস্তিক চার্বাক হোক অথবা আস্তিক শিরোমণি মীমাংসা হোক 'আমি কে', 'আমি কি', এটা জানার  আকুলতা ভারতীয় দর্শনকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। 

ভারতীয় দর্শনের ভিত্তিভুমি বেদে সুস্পষ্ট  নির্দেশ আছে "আত্মানং বিদ্ধি"(আত্মাকে জানো)। আলোকমনস্ক ঋষিগণ গভীর সাধনায় উপলব্ধি করেছিলেন  আত্মাকে জানলেই সব জানা হবে। ঐতেরেয়, বৃহদারণ্যক, মুন্ডক, এমন কি ছান্দোগ্য উপনিষদেও চরম সত্তাকে আত্মা বা সৎ বলা হয়েছে। উপনিষদ ভাষ্যে আত্মাকে পাঁচটি আবরনের দ্বারা আবরিত বলা হয়েছে।
1. আত্মা অন্নময় বা দেহের সঙ্গে অভিন্ন।কিন্তু আত্মা দেহ নয়, কারন দেহ বৃদ্ধির সাথে আত্মা বৃদ্ধি পায় না। 
2. আত্মা অন্নময় না হলে প্রাণময় হবে। কিন্তু  অজ্ঞান অবস্থায়  প্রাণ না থাকলেও আত্মা থাকে। 
3. তাহলে আত্মা মনোময়, কিন্তু মন অণুসম, আর আত্মা বিভু। 
4. আত্মা তাহলে বিজ্ঞানময় বা চৈতন্যময়। এই মতের সরাসরি বিরোধীতা  না করেও উপনিষদ এর নির্বিকল্প প্রত্যক্ষকারী আনন্দেই আত্মা বলার পক্ষপাতি। তাঁদের মতে "আনন্দং ব্রাহ্মণ্য ন বিভূতি কদাচন"(আত্মাকে আনন্দ বলে জানলে আর কোন ভয় থাকে না)। উপনিষদ এর সতর্কবাণী  ব্রহ্ম লাভে সদা উৎসুক তীক্ষ্ণধী ব্যক্তি  ছাড়া আত্মাকে আনন্দময় রূপে জানা একপ্রকার  অসম্ভব।

বৃহদারণ্যক উপনিষদ যাজ্ঞবল্ক মুনি তাঁর স্ত্রীকে উপদেশ দিয়েছিলেন "আত্মনস্থু কামায় সর্বংপ্রিয় ভবতি।" আত্মার আনন্দের জন্যই  আত্মার সাথে সংশ্লিষ্ট সব কিছু আনন্দময়। জীবন যে এতো প্রিয় তার কারন আত্মার  আনন্দ। প্রিয়জন যে এতো প্রিয় তার কারন সে আমার  আত্মা মিশে থাকে।তৈতেরিয় উপনিষদে বলা হয়েছে আত্মার আনন্দ আছে বলেই এই জগতে কেউ স্বেচ্ছায় মরতে চায় না। আত্মোপলব্ধি আনন্দোপলব্ধি। কঠোপনিষদ তো আরো একধাপ এগিয়ে বলেছেন, আমরা একসাথে অনেক জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হই বলে আনন্দ পাই না। কস্তুরী মৃগ যেমন তার নিজের নাভিদেশে গন্ধের উৎস না জেনে বনে বনে দুর্নিবার আকর্ষণে গন্ধ খুঁজে মরে, আমরাও তেমনি আত্মা কিসে আনন্দ পাবে তার না জেনে সুখের নেশায় নানা বিষয়ের পিছনে ছুটি। ফল দুঃখ ও বন্ধন। বিষয় বাসনা ত্যাগ করে আত্মস্থ হতে পারলেই আত্মা নিজেকে চিনতে পারবে ।

নাস্তিক শিরোমণি চার্বাক মতে, "চৈতন্য বিশিষ্ট দেহই আত্মা"। দেহাতিরিক্ত চেতনা আত্মা বলে কিছু নেই।দেহ রোগা হলে আমরা বলি 'আমি রোগা', দেহ ফর্সা হলে আমরা বলি 'আমি ফর্সা।এই প্রতিদিনের ব্যবহার্য কথার সূক্ষ্মতা প্রমান করে 'আমিই দেহ' বা 'দেহই আমি'। তবে তার্কিক নৈয়ায়িক সঙ্গত প্রশ্ন তোলে, দেহ সৃষ্টি হয় ক্ষিতি,অপ,তেজ,মরুতের প্রত্যক্ষযোগ্য জড় কণার দ্বারা।
তাই যদি হয় তবে অপ্রত্যক্ষযোগ্য চৈতন্য আবির্ভূত হয় কোন যাদুবিদ্যায়? আত্মপ্রত্যয়ী চার্বাক দের যুক্তি  খুব মনোগ্ৰাহী। তাঁদের মতে পান, চুন, সুপারি, খয়ের কোনটির মধ্যেই লালরং থাকে না, কিন্তু এরা একসাথে চর্বিত হলে যেমন লালরং এর উৎপত্তি  হয় ঠিক তেমনি ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এর প্রত্যক্ষযোগ্য জড় অণু নিজেদের সক্রিয় স্বাধীন ইচ্ছায় পরস্পরের সাথে মিলিত হলে দেহ গঠিত হয় সাথে চৈতন্যরূপ একটি নতুন গুনের সৃষ্টি হয়। উপনিষদ, 'অন্নময়' এর সহজ প্রকাশ দেখা যায়  চার্বাক মতবাদ। 

জৈনমতে, আমরা যখন গোলাপ দেখি তখন তার গোলাপী রং ই দেখি। গুন প্রত্যক্ষ করলে দ্রব্য প্রত্যক্ষ হয়। আমরা সুখ, দুঃখ ইত্যাদি দেহভিন্ন আত্মা আছে। গাড়ির মতো দেহ ইচ্ছানুযায়ী নিয়ন্ত্রিত করা যায়। গাড়ির যেমন চালক থাকেন, দেহের থাকে আত্মা। চালক যেমন গাড়ি নন, আত্মা তেমনি দেহ নয়। ভাবা যাক, ইন্দ্রিয়গুলি যেন য়ন্ত্র। এদের পরিচালক যন্ত্রী চাই। আত্মা এই যন্ত্রী।দেহ তো নানা পরমাণুর সৃষ্টি। অচেতন পরমাণু নিয়ন্ত্রণ করে একত্র করে চেতন আত্মা। জৈনদের ত্রিকালজ্ঞ তীর্থঙ্করগনের উপলব্ধি, প্রাক্তন কর্মজনিত বাসনার জন্য জীব পরপর বিভিন্ন  দেহ ধারণ করে। প্রদীপের মতো জীব যে দেহ ধারন করে সেই দেহের সমস্ত  অংশই আলোকিত হয়ে যায়। যদিও আত্মা নিরাকার, তথাপি প্রদীপের মতোই সে যখন যে দেহ ধারন করে তার রূপ পরিগ্রহ করে।

সাধারন মানুষের  বিশ্বাস, আমাদের বিভিন্ন  সময়ের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতায় একই অপরিবর্তিত সত্তা বর্তমান। এই সত্তাকে সাধারণত আত্মা নামে অভিহিত করা হয়। সাধারন লোকের বিশ্বাস, দৈহিক শত পরিবর্তনের মধ্যে এই আত্মা অপরিবর্তিত  থাকে। জন্মের পূর্বে এবং মৃত্যুর পরে এর স্থিতি এবং দেহ থেকে দেহান্তরে এর গতি। বুদ্ধদেব তাঁর প্রতীত্যসমুৎপাদ এবং অনিত্যবাদের সাথে সাযুজ্য  রেখে এইরকম আত্মার  অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, সবই অনিত্য শর্তাধীন।সুতরাং অপরিবর্তিত আত্মা বলে কিছু থাকতে পারে না।  বুদ্ধদেবের  মতে, আত্মা হলো দেহ, মন, এবং চেতনার  সমাহার। কিন্তু প্রশ্ন হবে, যদি আত্মা অপরিবর্তিত হয় তবে জন্মান্তরের প্রশ্ন  অবান্তর, এবং কর্মফলভোগ এক নৈতিক অসঙ্গতির মুখে পড়বে না কি? উত্তরে বুদ্ধদেব বলেন,আমাদের সমস্ত কর্মফল 'আলয়-বিজ্ঞানে' সম্ভাবনা রূপে বিরাজ করে। সারারাত জ্বলা নিরবচ্ছিন্ন দীপশিখা যেমন পৃথক, পৃথক সলতে, তেল, এবং সময়ের সমাহার ঠিক তেমনি আত্মা বিভিন্ন খন্ড মুহূর্তের নিরবচ্ছিন্ন দ্রষ্টা, সাক্ষী।বৌদ্ধদের  আত্মবাদ তাই নৈরাত্মবাদ নামে নিন্দনীয় হয়।

নৈয়ায়িকদের মতে, আত্মা একটি দ্রব্য। চেতনা তার একটি আগন্তুক গুণ। আত্মা যখন দেহের সাথে  যুক্ত হয় এবং ইন্দ্রিয় বিষয় সংশ্লিষ্ট হয়, তখনি চেতনা গুণ আত্মার আবির্ভূত হয়ে থাকে। আত্মা যখন দেহমুক্ত হয়, তখন তাতে চৈতন্যগুণ থাকে না। আত্মা নিত্য ও অমর। দেশ ও কালের দ্বারা আত্মাকে বাধিত করা যায় না। কোন অবস্থাতেই  তা বাধিত হয় না বলে তা বিভু। অধিষ্ঠান বা আধার ছাড়া চৈতন্য  থাকতে পারে না। সেইজন্য নৈয়ায়িকরা আত্মা বলতে চৈতন্য গুণ বিশিষ্ট একটি দ্রব্য বোঝেন জাজ্বল্যতা অহংবোধের আধার, এবং ভোক্তা। 

মীমাংসা মতে,আত্মা নিত্য, অসীম, দ্রব্য বিশেষ,যে দেহে আত্মা অবস্থান করে তা মিথ্যা বা মায়া নয়, তা সত্য। বস্তুর সাথে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ ঘটলে আত্মায় চৈতন্য  গুণের আবির্ভাব হয়। বস্তুর সাথে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ ঘটলে আত্মায় চৈতন্য গুণের আবির্ভাব হয়। নইলে আত্মার চৈতন্য  আসে না। যত ব্যক্তি তত আত্মা। আমরা যখন কোন বিষয়কে জানি তখন বিষয়, বিষয়ের জ্ঞান, বিষয়ের জ্ঞাতা একই সঙ্গে  প্রকাশিত হয়।

সাংখ্য মতে আত্মাকে পুরুষ বলা হয়েছে।আত্মা বা পুরুষ দেহ,মন, ইন্দ্রিয়,এবং বুদ্ধি থেকে স্বতন্ত্র।আত্মা জ্ঞাতা, জ্ঞানের বিষয় নয়। পরিবর্তন, কতৃত্ব, সুখ-দুঃখ প্রভৃতির উর্দ্ধস্থিত পুরুষের অস্তিত্ব সাংখ্যকারেরা অনুমান করে প্রমাণ করেন।
"সংঘাত পরার্থত্বাৎ ত্রিগুনাদি বিপর্যয়াদধিষ্ঠানাৎ;
পুরুষোহস্তি ভোক্তৃভাবাৎ কৈবল্যার্থাং প্রবৃত্তেশ্চ।।"

বেদান্ত মতে, আত্মা জ্ঞাতা, কর্তা বা ভোক্তা নয়। আত্মা চৈতন্য ও আনন্দস্বরূপ। আত্মা একমাত্র সৎ। আত্মা নিত্য শুদ্ধ, নিত্য বুদ্ধ, নিত্য মুক্ত। অজ্ঞান জন্য জীব এই স্বরূপ বিস্মৃত  হয়, এবং অনাত্ম দেহের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করে। এরই নাম বন্ধন। জীব মুক্ত হলে তার ব্রহ্মত্ব উপলব্ধ হয়।উপনিষদের 'তত্ত্বমসি' বাক্যে এর স্বরূপগত অভেদ প্রকাশিত  হয়। 

বেদ-উপনিষদের আলোকে ভারতীয় দর্শনের আত্মার চালচিত্রে যে কথা না বললেই নয় তা হলো আত্মা 'সচ্চিদানন্দ' স্বরূপ। নিদ্রা থেকে জাগরণের প্রথম মুহূর্তে  নিজেই নিজেকে আনন্দোপলব্ধি এর প্রমাণ। এখানে আনন্দ আর চৈতন্য সমব্যপক। এই অভিজ্ঞতা  ত্রিকাল অবাধিত, তাই তা সৎ। 'বিশ্ব আমির' রচনার আসরে রেখায়, রঙে, সুখে, দুঃখে, আমার 'পুলকিত চিত্ত'  আমার  প্রমাণ।।

ABOUT OUR AUTHOR:

Masters in Philosophy. Teacher by profession and student of life. A proud mother & dutiful wife. Life is revolving around literature & dreams.




Comments

  1. বেশ ভালো লাগলো

    ReplyDelete
  2. সহযাত্রী হই অনুভবে, পুলক লাগে প্রাণে.....
    একাত্মতাই আমি... হয়তো আত্মাও।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

POETRY by SOURAV BARDHAN

POETRY by ATANU PRAMANIK

ESSAY by BODHISATTYA PAL